অন্যান্য প্রচ্ছদ 

রাজ্যে সংখ্যালঘু বঞ্চনা ও কিছু কথা : মোস্তফা কামাল

শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

রাজ্যে সংখ্যালঘু বঞ্চনা ও কিছু কথা

মোস্তফা কামাল : স্বাধীনতার সাত দশক পেরিয়ে গেছে। গঙ্গা দিয়ে প্রচুর জল গড়িয়েছে। ভারতবর্ষের পাশাপাশি এই রাজ্যের রাজনৈতিক চিত্রের আমূল পরিবর্তন হয়েছে বারবার কিন্তু রাজ্যের মুসলমানদের সমাজিক চিত্রের আজ পর্যন্ত কোনো পরিবর্তন হয়নি। স্বাধীনতার পর থেকে তাদের নিয়ে শুধু ভোট রাজনীতি হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।ক্ষমতার স্বাদ তারা কোনোদিনই পায়নি। বিভিন্ন সময়ে শাসক দলের প্রলোভনে তাদের ফুটবল হয়ে লাথি খেয়ে এরা হয় লেঠেল বাহিনীতে পরিণত হয়েছে অথবা রাজনৈতিক নেতাদের উচ্ছিষ্টভোগী হয়েছে।এই পরম্পরা থেকে মুক্ত করতে আজ পর্যন্ত কোনো দলই মুসলমানদের পাশে দাঁড়ায়নি।অথচ মুসলমান সম্প্রদায়ই সব সময় তুরুপের তাস হয়ে শাসক দলকে ক্ষমতা চ্যুত করেছে আবার বিরোধী দলকেও ক্ষমতায় বসিয়েছে।

বামফ্রন্টের আমলে ২০০৬ এ প্রকাশিত সাচার কমিটির রিপোর্ট সকলের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল দীর্ঘ ৩৫ বছর ক্ষমতায় থেকেও তারা বৃহত্তর মুসলিম সংখ্যালঘুদের কোনো উন্নয়নই করেননি।তাদের শুধু ভোটব্যাঙ্ক হিসেবেই ব্যবহার করে গেছেন। ফলে রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলিমদের অবস্থান আদিবাসী উপজাতিদের থেকেও করুণতম স্থানে অবস্থান ছিল।পরবর্তীতে সরকারের পরিবর্তন হয়েছে। অবহেলিত সংখ্যালঘু মুসলিমরা আশায় বুক বেঁধেছেন কিন্তু দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত সাচার কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য বর্তমান সরকারের কোনো পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। যদিও ক্ষমতায় এসে ২০১১ সালে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সাচার কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে মুসলিম সমাজের উন্নয়নে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করবেন।মুসলমানরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন যে, সামাজিক ন্যায্যতার স্বাভাবিক তাগিদেই এবার হয়তো শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে কর্মনিয়োজনে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব সংক্রান্ত সমস্যা ও বঞ্চনাগুলো দূর হবে। তৃণমূল সরকারের দীর্ঘ ১২বছর পরেও মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি এখনও বিশ বাঁও জলে।

Advertisement

২০১৬ সালে অ্যাসোসিয়েশন স্ন্যাপ এবং গাইডেন্স গিল্ড, প্রতীচী ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে সেখানেও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার দীর্ঘ সময় পরেও পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমরা সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা এমনকি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কতটা পিছিয়ে রয়েছে। এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে, সরকারের পরিকল্পিত ঔদাসীন্য না থাকলে কখনোই একটি সম্প্রদায় এইভাবে পিছিয়ে থাকতোনা।

রাজ্যে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রায় ৩০ শতাংশের বেশি মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করেন।তারা বর্তমান শাসক দলের অন্ধ আনুগত্য দেখালেও তারা শুধু দুধেল গাই এ পরিণত হয় কিন্তু তাদের পিছিয়ে রাখতে সবরকম প্রচেষ্টাও নেওয়া হয়। তাইতো দেখা যায় ২০১৮-১৯ সালের কেন্দ্রীয় উচ্চ শিক্ষার রিপোর্ট অনুসারে রাজ্যের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে তাদের প্রতিনিধিত্ব অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। মাত্র ৬.৯ শতাংশ। তবে যতটুকু প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে,তা মুসলিমদের ওবিসি সংরক্ষণের আওতায় আনার ফলে। বলাবাহুল্য, সরকারের একশ্রেণীর আধিকারিকদের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের কারণে এখানেও মুসলিম ওবিসি সংরক্ষণ ঠিক মতো মানা হচ্ছে না বলে নানা সময়ে অভিযোগ উঠছে।

স্নাপ ও গাইডেন্স গিল্ড-এর যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত পাবলিক রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, এক হাজার বা তার বেশি জনসংখ্যাবিশিষ্ট মুসলমান-অধ্যুষিত গ্রামে এখনও তিন শতাংশতে কোনও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। যেটুকু রয়েছে সেখানে শিক্ষার উপযুক্ত পরিকাঠামো অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক।উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমান ছাত্র ছাত্রীদের পরিসংখ্যান মাত্র ৩-৪ শতাংশ।আবার কিছু বিখ্যাত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যেখানে মুসলমান ছাত্রদের সংখ্যা নেই বললেই চলে।রাজনৈতিক কারণ হোক বা আইনী জটিলতার কারণে হোক রাজ্যের মাদ্রাসা সহ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে কোনো নিয়োগ নেই। ছিটেফোঁটা কোথাও নিয়োগ হলেও সেখানেও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ওঠে।

আমরা প্রায়শই লক্ষ্য করি, ইদানিং কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে ঈদের দিনেও বিভিন্ন পরীক্ষা রাখা হয়। পরবর্তীতে প্রতিবাদ হলে দিনক্ষণ পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। কেন এমনটি হবে?এটা কি সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে একশ্রেণীর আধিকারিকদের উদ্দেশ্য প্রণোদিত অপকর্ম নাকি সরকারের প্রচ্ছন্ন মদতে তারা এই কাজগুলো করে থাকেন এই প্রশ্ন আম জনতার।

স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন পরিকাঠামোর অভাব পরিলক্ষিত হয় মুসলিম এলাকায়।স্ন্যাপ-গিল্ড প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, যে সমস্ত ব্লকে ১৫ শতাংশের কম মুসলমান বসবাস করেন সেখানে প্রতি ১ লক্ষ মানুষের জন্য ২.৩ টি হাসপাতাল রয়েছে। সেখানে বেডের সংখ্যা রয়েছে দ্বিগুন কিন্তু যে সমস্ত ব্লকে ৫০ শতাংশ বা তার বেশি মুসলমান মানুষের বাস সেখানে প্রতি লক্ষ মানুষের জন্য হাসপাতাল রয়েছে মাত্র ১.৪টি।সেখানে বেডের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে ভয়ানক কম। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে দুধেল গাইদের প্রতি কেন এই বঞ্চনা?

রাজনৈতিক বলিদানে এই রাজ্যের মুসলিমদের অবদান কোনো অংশে কম নয়। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে পশ্চিমবঙ্গে একমাত্র মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ক সরকার নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা রাখে। কিন্তু কী আশ্চর্য!সব রাজনৈতিক দলই মুসলিমদের ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবে ব্যবহার করে কিন্তু ক্ষমতায় এলে কোনো দলই তাদের কোনো ক্ষমতায় রাখেনা।স্বাধীনত্তোর ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে এই রাজ্যে আজ পর্যন্ত সংখ্যালঘু মুসলিমদের একজনকে মুখ্যমন্ত্রী তো দূরের কথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীও করা হয়না।শিক্ষা ও স্বাস্থ্য দফতরের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে পূর্ণমন্ত্রী করা হয়নি কোনো মুসলিমকে।এমনকি মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে কোনো মুসলিমকে আজ পর্যন্ত রাখা হয়নি।যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পুলিশে এবং প্রশাসনের রাজ্যের সর্বোচ্চ পদে আজ পর্যন্ত কোন মুসলিমের দেখা মেলে না।

বর্তমান সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির উচিত যেহেতু তিনিই এই রাজ্যের সরকারের প্রধান সেহেতু পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের শুধুমাত্র ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে না রেখে তাদের সংখ্যানুপাতে সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করে তাদের আস্থা অর্জন করে সরকারের দায়িত্বের পরিচয় দেওয়া।তা না হলে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে সংখ্যালঘু মুসলিমরা তাদের সাংবিধানিক অধিকারের প্রশ্নে আগামীতে বর্তমান শাসক দলকে ক্ষমতাচ্যুত করতে একত্রিত হবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

একথা নিশ্চয়ই অস্বীকার করার উপায় নেই যে, রাজ্যের অবহেলিত মুসলিম সম্প্রদায় বামফ্রন্টের ভোটব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে এসে মাননীয়া মমতা ব্যানার্জির প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রেখে ২০১১তে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করিয়ে তৃণমূল সরকারকে ক্ষমতায় এনেছিল। কিন্তু দীর্ঘ ১২ বছরেও এই সম্প্রদায়ের প্রকৃত উন্নয়ন কেন হয়নি এই প্রশ্ন উঠে আসা স্বাভাবিক।যদিও এখনও তারা তৃণমূলের ভোট ব্যাঙ্ক হয়ে মমতা ব্যানার্জির উপর আস্থা রেখে চলেছে।

সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতর যেহেতু মুখ্যমন্ত্রীর হাতে সেই হেতু রাজ্যের বিভিন্ন সেক্টরে মুসলিমদের যে করুণ দুর্দশা পরিলক্ষিত হয় তা নিরসনে সরকারের আন্তরিক সদিচ্ছা সংখ্যালঘুরা প্রত্যাশা করে।তা না হলে এই সমাজের ভোট ব্যাঙ্ক খুব বেশি দিন তৃণমূল ধরে রাখতে পারবে বলে মনে হয়না। রাজ্য সরকারের রাজনৈতিক পলিসি হিসেবে ইমাম মোয়াজ্জিনদের ভাতা দিয়ে হয়তো কিছু দিন সংখ্যালঘুদের ব্যবহার করা যেতে পারে, রাজনীতি করা যেতে পারে কিন্তু তা চিরদিন চলতে পারেনা। তারা একবার বিমুখ হয়ে গেলে আর কখনোই ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে তৃণমূলের দিকে ফিরবেনা। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ধারা এটাই প্রমাণ করে।


শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সম্পর্কিত নিবন্ধ